প্রকৃতির রঙতুলিতে সাজানো সাতছড়ি
জীবনের ব্যস্ত সময় কাটানোর মধ্যেও প্রত্যেক মানুষ চায় একটু আনন্দ। চায় একটু বিনোদন। বাংলাদেশ ছোট ভৌগলিক সীমারেখার দেশ। কিন্তু প্রকৃতি তার আপন খেয়ালে এ দেশটিকে নিজ হাতে সাজিয়েছে। তাই এ দেশের রূপ লাবণ্যে বিশ্বের খ্যাতনামা পর্যটকরাও মোহিত হয়েছেন। প্রশংসা করেছেন বাংলার সৌন্দর্য্যরে। এ দেশ যেমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে লীলাভূমি, তেমনি এ দেশের মানুষও প্রকৃতিপ্রেমী, সৌন্দর্য্য পিয়াসী। তাই দেশের যেখানেই প্রকৃতির ব্যতিক্রমী সৌন্দর্য্যলীলার খবর পান সেখানেই তারা ছুটে যান। তাই দেশেও দিন দিন পর্যটন কেন্দ্রের সংখ্যা বেড়েই চলছে। দেশের পর্যটন কেন্দ্রের অন্যতম একটি হচ্ছে সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান। এ উদ্যানকে ঘিরে প্রকৃতিপ্রেমী পর্যটকদের আগ্রহের শেষ নেই। প্রতিদিনই হাজার হাজার পর্যটক সবুজের গালিচা বিছানো এই উদ্যান দেখতে ভিড় করেন সাতছড়িতে। সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের অবস্থান সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলায়। দেশের ১০টি জাতীয় উদ্যানের মধ্যে এটি অন্যতম। এর আয়তন ২৪২ দশমিক ৮২ হেক্টর বা ৬০০ একর। এটি রঘুনন্দন হিল রিজার্ভ ফরেস্টের একটি অংশ। ঢাকা থেকে প্রায় ১৩০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে এবং শ্রীমঙ্গল থেকে ৬০ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে এ উদ্যানটি অবস্থিত। সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান একটি ট্রপিকেল রেইন ফরেস্ট বা মিশ্র চির সবুজ এবং পত্রঝরা বন। ইকো ট্যুর গাইডের সাহায্য নিয়ে জীব বৈচিত্র্যে ভরপুর সাতছড়ি উদ্যান ঘুরে দেখলে অপূর্ব বনশ্রী যে কোন পর্যটকের হৃদয়ে দাগ কাটবে নি:সন্দেহে। যে কোন পর্যটক সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানটি ঘুরে না দেখে এর সৌন্দর্য্য সম্পর্কে অনুমানও করতে পারবেন না। তাই সাতছড়ি উদ্যানের সবুজের মিছিল দেখতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাজার হাজার পর্যটক ছুটে আসেন এখানে। সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের নামকরণেরও রয়েছে একটি ইতিহাস।
এই উদ্যানের ভেতর দিয়ে ৭টি ছোট খাল বা ছড়া প্রবাহিত হয়েছে। বর্ষায় খালগুলো কিছুসময় পানিতে ভরপুর থাকলেও পরবর্তীতে তা শুকিয়ে যায়। তবে অবাক হওয়ার বিষয় হচ্ছে, ছড়াগুলোর মধ্যে প্রকৃতি তার আপন নিয়মে বিছিয়ে রেখেছে গুঁড়ো দুধের ন্যায় সাদা বালু। অপূর্ব সুন্দর ওই সাতটি ছড়ার জন্যই উদ্যানটির নাম হয়েছে সাতছড়ি। দুধ রঙ বালুর এই ছড়াগুলো ধরে যে কোন পর্যটক পায়ে হেঁটে যেতে পারেন উদ্যানের অভ্যন্তরে। তখন মনে হবে কেউ হয়তো শুভ্র গালিচায় অভ্যর্থনা জানাতে এ প্রয়াস চালিয়েছে। ছড়ার পথে হাটতে হাটতে চারদিকে খেয়াল রাখলে দেখতে পাবেন বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষরাজি ও নাম না জানা অসংখ্য জাতের লতাপাতা। সাতছড়িতে উল্লেখ্যযোগ্য গাছগাছালির মধ্যে রয়েছে চাপালিশ, আউয়াল, কাকড়া, হারগাজা, হরতকি, পাম, লটকন, আমড়া, গামার, কাউ, ডুমুর ইত্যাদি। এ বৃক্ষগুলোর ফল খেয়ে উদ্যানে বসবাসকারী নানাজাতের পশু-পাখি বেঁচে থাকে। উদ্যানে বসবাসকারী প্রাণীদের মধ্যে রয়েছে উল্লুক, বানর, চশমাপরা বানর, হনুমান ইত্যাদি। উদ্যানের সবুজের ভেতর হারিয়ে যেতে পারলে আপনি হয়ত দেখতে পারবেন দুর্লভ জাতের এসব পশু। উদ্যানের এগাছ থেকে ওগাছে ছুটে বেড়ায় শ্যামা, ময়না, বাসন্তী বাউরী, ফোটা কন্ঠী, সাতবাইলা প্রভৃতি পাখি। পাখির কিচিরমিচির শব্দে জুড়িয়ে যাবে যে কোন পর্যটকের মন। গাছের ফল পাখির ঠুকরে খাওয়ার দৃশ্যও পর্যটকদের মোহিত করে। পশু-পাখি ছাড়াও সাতছড়িতে রয়েছে বিরল প্রজাতির মাকড়শা। অভিনব শিকার পদ্ধতিতে পোকাদের তাদের জালে আটকে নিজেদের উদরপুর্তি করে। এমন দৃশ্য সাধারণত সচরাচর চোখে না পড়লেও সাতছড়িতে তা সহজে দেখা যাবে। শুধু তাই নয়, উদ্যানের ভেতর হাটতে হাটতে দেখতে পারেন প্রাচীন ফসিল বা পুরাতন বৃক্ষ খন্ড পাথর হয়ে গেছে। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। রূপকথার মতো মনে হলেও প্রকৃতির নিজের গড়া সত্য অস্তিত্বগুলো আপনাকে অনেক কিছু শেখাতে পারে। কিন্তু উদ্যানে হাটতে গিয়ে কখনোই প্রকৃতির সৌন্দর্য্য নষ্টের চেষ্টা করা উচিত হবে না। সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের মধ্যে রয়েছে আদিবাসি পল্লী। আদিবাসী পল্লীতে নারীরা নিজের হাতে কাপড় বুনছে। দেখা যাবে আদিবাসীদের জীবনযাত্রা আর কৃষ্টি কালচার। একটু সৌহাদ্যপূর্ন আচরণের মাধ্যমে আপনি স্থানীয়দের কাছ থেকে জেনে নিতে পারেন তাদের বৈচিত্র্যময় জীবনধারা সম্পর্কে।
Post a Comment
Thenks for your comments.