যখন ঘুরতে যাবেন রংপুরে
‘‘দেখবো বাংলাদেশ গড়বো বাংলাদেশ” এই স্লোগান নিয়ে পায়ে হেটে তেতুলিয়া থেকে টেকনাফ পর্যন্ত দেশ ঘুরে ঘুরে জাহাঙ্গীর আলম শোভন। হাঁটা প্রকল্পের স্পন্সর হিসেবে আছি আমরা ট্যুর.কম.বিডি। অনিন্দ্য বাংলাদেশের বাঁকে বাঁকে যে ঐতিহাসিক কিংবা দর্শনীয় স্থান রয়েছে যা অনেকেরই অজানা, সেই স্থানগুলিকে সবার দৃষ্টিরমধ্যে নিয়ে আসার জন্যই ট্যুর.কম.বিডি-এর প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা ছিল।পায়ে হেঁটে তেতুলিয়া থেকে টেকনাফ ভ্রমন সফল ভাবে শেষ করে তিনি অনিন্দ্য বাংলাদেশ ঘুরে যে রত্নগুলো পেয়েছেন তার কিছু অংশ এখানে তুলে ধরা হলো । আজকের আয়োজন সম্পূর্ণটাই বাংলাদেশের নতুন বিভাগ রংপুরকে নিয়ে ।
লিখেছেন : জাহাঙ্গীর আলম শোভন
রংপুর জেলার নাম মনে হলে আমার নিজের ছোটবেলায় রঙীন এক জগতের চিত্র ভেসে উঠতো। পরে মনে হতো এখানে মনে হয় রং পাওয়া যায়। আর রং মানে লাল সবুজ হলুদ নীল আরো কতো কি। রংপুর জেলার নামকরনের ইতিহাস থেকে জানা যায়। কথিত আছে ‘রঙ্গপুর’ থেকেই কালক্রমে এই নামটি এসেছে।
ব্রিটিশ ভারতে ইংরেজরা নীলের চাষ শুরু করে। এই অঞ্চলে মাটি উর্বর হবার কারনে এখানে প্রচুর নীলের চাষ হত। সেই নীলকে স্থানীয় লোকজন রঙ নামেই জানত। কালের বিবর্তনে সেই রং থেকেই আজকের রংপুর। আবার আরেকটি মত হলো যে, রংপুর জেলার পূর্বনাম রঙ্গপুর। প্রাগ জ্যোতিস্বর নরের পুত্র ভগদত্তের রঙ্গমহল এর নামকরন থেকে এই রঙ্গপুর নামটি রংপুরের দর্শনীয় স্থানের মধ্যে রয়েছে কেরামতিয়া মসজিদ ও মাজার, তাজহাট জমিদারবাড়ি, বেগম রোকেয়ার স্মৃতিধন্য পায়রাবন্দ গ্রাম, ভিন্ন জগৎ ও ঝাড়বিশলা।
ঐতিহাসিক কেরামতিয়া মসজিদ
কেরামতিয়া মসজিদ রংপুর জেলার প্রধান আকর্ষণ ভারতের জৈনপুর থেকে আগত বাংলাদেশে মুসলিম সংস্কার আন্দোলণের অবিস্মরনীয় পুরোধা মাওলানা কেরামত আলী (রাঃ) জৈনপুরী। তিনি ১২১৫ হিজরীর ১৮ মহরম তারিখে জৈনপুরে জন্মগ্রহণ করেন।
রংপুরে তিনি ইসলাম প্রচারের জন্য আসেন এবং এখানে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। মসজিদের পাশেই রয়েছে তার মাজার। আয়তাকার মসজিদটির আভ্যমত্মরীন পরিমাপ ৪২ বাই ১৩ ফুট। পূর্ব ও পশ্চিম
দিকের দেওয়াল ৩ ফুট চওড়া এবং উত্তর ও দক্ষিন দিকের দেওয়াল ২ ফুট প্রশস্ত। মসজিদে ৩টি গম্বুজ, গম্বুজগুলো অষ্টকোণী ড্রামের উপর ভর করে নির্মিত বলে মনে করা হয়। প্রতিটি গম্বুজের নিচের দিকে সেযুগে প্রচলিত মারলন অলংকরণ, মধ্যবর্তী স্থান প্রস্ফুটিত পদ্মফুলের উপরে কলসমোটিফ ফিনিয়াল ধরনে চূড়া রয়েছে। এ ধরনের চূড়া পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেখতে পাওয়া যায়। মসজিদের চারকোণে অষ্টভূজাকৃতি স্তম্ভ আছে। এগুলোর শীর্ষে রয়েছে কিউপলা। নানা অলংকরণ, স্থাপন্যকলা এবং বিভিন্নযুগের ও দেশের স্থাপত্য নির্দর্শন রয়েছে এই মসজিদের গাঁথুনিতে। মসজিদের প্রধান দরজাগুলো চতুকৌণিক খিলনাকৃতি মসজিদের দেয়ালে রয়েছে পত্র পল্লব শোভিন নানা অলংকরণ। মসজিদে কোন শিলালিপি পাওয়া যায়নি বলে এর নির্মাণকাল সম্পর্কে সঠিক ধারণা মেলে না , তবেএ মসজিদের স্থাপত্যশৈলী অনুযায়ী এটা মুঘল আমলের হয়ে থাকবে। প্রাসাদটি কালের বিবেচনায় খুব পুরনো নয়। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে মহারাজা কুমার গোপাল লাল রায় এটা নির্মাণ করেন। কথিত আছে, তার মনমুগ্ধকর 'তাজ' বা মুকুটের কারণেই এ এলাকা তাজহাট নামে অভিহিত হয়ে আসছে। বর্তমানে এটি একটি জাদুঘর। এতে বেশ কয়েকটি প্রদর্শনী কক্ষ যাতে রয়েছে দশম ও একাদশ শতাব্দীর টেরাকোটা শিল্পকর্ম। এখানে রয়েছে সংস্কৃত এবং আরবি ভাষায় লেখা বেশ কিছু প্রাচীন ও দূর্লভ পাণ্ডুলিপি। মুঘল সম্রাট আওরাঙ্গজেবের সময়ের কুরআন সহ মহাভারত ও রামায়ণ আছে এখানে। পেছনের ঘরে পাথরের হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর প্রতিকৃতি রয়েছে।
এর গঠনশৈলীবাংলাদেশের অন্য সকল প্রাসাদের থেকে ভিণ্ন কারণ সর্বমোট ৩১ টি সিড়ি আছে যার প্রতিটাই ইতালীয় ঘরানার মার্বেল পাথরে তৈরী। সিঁড়ি থেকে উঠে জাদুঘর পর্যন্ত মেঝের পুরোটাও একই পাথরে তৈরী। রাজবাড়ীর পশ্চাৎভাগে গুপ্ত সিঁড়ি রয়েছে। প্রাসাদের সুন্দর ফোয়ারাটি কালের বিবর্তনে শ্বেতশুভ্র মার্বেল ও তার সবুজাভ নকশা কিছুটা মলিন হলেও এখনো এর জৌলুষ বুঝা যায়। রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্ধগ্রামে রয়েছে এদেশের নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগমরোকেয়ার জন্মবসত ভিটা। যেকেনো শিক্ষিতমানুষকে টানবে তার বাড়ী। বর্তমানে এখানে তৈরী করা হয়েছে বেগম রোকেয়া স্বমৃতিকেন্দ্র।পায়রাবন্দ গ্রামে বেগম রোকেয়ার পৈতৃক ভিটায় ৩ দশমিক ১৫ একর ভূমির ওপর এই কেন্দ্রটি অবস্থিত। একটি সরকারী প্রতিষ্ঠান। এতে আছে অফিস ভবন, সর্বাধুনিক গেস্ট হাউজ, ৪ তলা ডরমেটরি ভবন, গবেষণা কক্ষ, লাইব্রেরি ইত্যাদি। সরকারী উদ্যোগে নির্মিত এই কেন্দ্রটির পরিচালনায় বর্তমানে নিয়োজিত রয়েছে বাংলাদেশ সরকারের শিশু ও মহিলা
ভিন্নজগত:
বেসরকারিভাবে প্রায় ১শ’ একর জমির উপর গড়ে ওঠা এই বিনোদন কেন্দ্রটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড়ো এমিউজমেন্ট পার্ক। ভিন্নজগতের প্রধান ফটক পার হলেই তিন দিকের বিশাল লেক ঘেরা নয়নাভিরাম দৃশ্য এখানে রয়েছে দেশের একমাত্র প্রথম বেসরকারী প্লানেটোরিয়াম।ছায়াঢাকা ও পাখিডাকা একটি গ্রামের মতোই এই ভিন্ন জগত। এখানে চিত্ত বিনোদনের জন্য রয়েছে নানা আয়োজন। রয়েছে রোবট স্ক্রিল জোন, স্পেস জার্নি, জল তরঙ্গ, সি প্যারাডাইস, আজব গুহা, নৌকা ভ্রমণ, শাপলা চত্বর, বীরশ্রেষ্ঠ এবং ভাষা সৈনিকদের ভাস্কর্য, ওয়াক ওয়ে, থ্রিডি, সুইমিং পুল স্পিনিং হেড, মাছ ধরার ব্যবস্থা। একই সঙ্গে রয়েছে অন্তত ৫শ’টি পৃথক দলের পিকনিক করার ব্যবস্থা। শুধু ভেতরেই রয়েছে অন্তত ৮/৯শ’ গাড়ি পার্কিংয়ের সুবিধা। কটেজ রয়েছে ৭টি। রয়েছে থ্রি স্টার মডেলের ড্রিম প্যালেস। রাত্রি যিাপন কিংবা অবকাশ যাপন কোনেটার জন্যই ভিন্নজগতকে বাছাই করা ভূল হবে না।
শিশুদের জন্য রয়েছে ক্যাঙ্গারু, হাতি, ঘোড়াসহ নানা জীবজন্তুর মূর্তি।এখানকার কর্মচারীদের ভাষ্যমতে শুকনো মৌসুমে গড়ে প্রতিদিন এক লাখ ভ্রমনপিয়াসী লোকের সমাগম ঘটে। বিশেষকরে স্কুল কলেজের শিক্ষাসফর ও অফিস কোম্পানীর পিকনিকের গাড়ীগুলো ভরে যায় এখান চত্বর। মজার ব্যাপার হলো ভিন্ন জগতের মালিক জনাব মোস্তফা কামাল একজন নোয়াখালীর মানুষ এটা এখানকার মোটামোটি সবার মুখে মুখে।
ঝড়বিশলা :
কবি হায়াত মাহমুদের সমাধি বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার ঝাড়বিশলা গ্রামে ১৬৯৩-এ কবি হেয়াত মামুদ জন্মগ্রহন করেন। কবির বংশগত উপাধি শাহ হলেও কাজীর পদ লাভ করার জন্য তাঁকে কাজী বলা হতো। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ: জঙ্গনামা,সর্বভেদ বাণী, হিতজ্ঞান বাণী, আম্বিয়া বাণী ইত্যাদি।১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দে এ মহানকবির সলিল সমাধি ঘটে।
বলা হয়ে থাকে যে ইনি হলেন মধ্যযুগের কাব্যধারার বাংলা কবিতার শেষ রংপুরে বেড়াতে গেলে রংপুর শহরে থাকতে পারবেন, এখানে রয়েছে সরকারী ও বেসরকারী বিভিন্ন রেস্টহাউস।
সরকারী রেস্টহাউসগুলোতে থাকা শর্তসাপেক্ষ। সে তুলনায় যেকোন প্রাইভেট হোটেলে থাকতে পারেন। আর বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন এর যে মোটেলটি রয়েছে রংপুরে এটি অনিন্দ সুন্দর। এখানেও
থাকতে পারেন। সাধারণ অতিথি হিসেবে যেকেউ এখানে গিয়ে থাকতে পারেন। উপজেলায় পর্যায়ে বলতে গেলে রংপুরের কোনো উপজেলাতেই এখনো বেসরকারী বোর্ডিং ব্যবসায় চালু হয়নি। তবে সরকারী জেলাপরিষদ ডাকবাংলোতে থাকতে পারবেন। তবে এরকম থাকার প্রয়োজন হলে স্থানীয় প্রশাসনের সাথে আগেই
১ : রাস্তার পাশে তামাক শুকানো এটা রংপুরের চিরাচরিত ছবি।
ছবি: লেখক
২ : কারামাতিয়া জামে মসজিদ। ছবি সংগ্রহ
৩ : তাজহাট জমিদার বাড়ী।
ছবি সংগ্রহ
৪ : বেগম রোকেয়ার বাড়ী যাওয়ার পথে গেট।
ছবি লেখক
৫ : বেগম রোকেয়ার স্মৃতি রক্ষায় স্মৃতিকেন্দ্র।
বেগম রোকেয়ার প্রতিকৃতি: ছবি সংগ্রহ
৭ , ৮, ৯: ভিন্নজগতের কয়েকটি ছবি।
ছবি লেখক
১১. পুষ্পশোভিত সরকারী মোটেল।
ছবি লেখক
১২. চিরাচরিত গ্রামীণ দৃশ্যপট রংপুরের।
Post a Comment
Thenks for your comments.